আলহামদু লিল্লাহ।.
মূল অবস্থা হলো: ঋণগ্রহীতা যে মুদ্রায় ঋণ নিয়েছেন সেই মুদ্রাতেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তবে যদি উভয়পক্ষ ঋণ পরিশোধের সময় ভিন্ন মুদ্রা গ্রহণে সম্মত হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে শর্ত হলো সেটি পরিশোধের দিনের মূল্যে হতে হবে। ঋণের সময় যে মূল্য ছিল সেই মূল্যে নয়। এটি প্রতি দফার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উভয়পক্ষ ভিন্ন মুদ্রায় পরিশোধের দিনের মূল্যে প্রদান করার ব্যাপারে সম্মত হতে পারবে।
আপনাকে জানতে হবে যে এই লেনদেনের হারাম রূপসমূহ তিনটি:
প্রথম রূপ:
ঋণের চুক্তির সময়েই উভয়পক্ষ ভিন্ন মুদ্রায় পরিশোধের ব্যাপারে সম্মত হওয়া। এটি হারাম। কেননা তখন লেনদেনটির স্বরূপ এমন: নগদ মুদ্রাকে বাকীতে ভিন্ন মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করা। এটি ربا النسيئة তথা বিলম্বগত সুদের মধ্যে পড়ে। কারণ বিভিন্ন মুদ্রা বিনিময়ের শর্ত হলো সেগুলো হাতে হাতে হতে হবে। এর প্রমাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “সোনার দ্বারা সোনা, রূপার দ্বারা রূপা লেনদেন (কম-বেশি না করে) একই রকমে সমপরিমাণে ও হাতে হাতে (অর্থাৎ নগদে বিক্রয় করবে)।... যদি ঐ জিনিসগুলোর প্রকার আলাদা হয় তখন নগদে তোমরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বিক্রয় কর।”[হাদীসটি মুসলিম (১৫৭৮) বর্ণনা করেন উবাদাহ ইবনুস সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে]
আর বর্তমান মুদ্রাগুলো স্বর্ণ-রৌপ্যের স্থলাভিষিক্ত। তাই স্বর্ণ-রৌপ্য ক্ষেত্রে যে যে বিধান প্রযোজ্য এগুলোর ক্ষেত্রেও সেই সেই বিধান প্রযোজ্য।
দ্বিতীয় রূপ:
লেনদেনের চুক্তি করার সময়ে তারা এ ব্যাপারে সম্মত না হয়ে ঋণ পরিশোধের সময় ভিন্ন মুদ্রায় পরিশোধের ব্যাপারে সম্মত হওয়া। কিন্তু উভয় পক্ষ ঋণ প্রদানের দিনের মূল্যের ভিত্তিতে এর মূল্য নির্ধারণ করা। পূর্বের রূপের মত এটিও হারাম। এমন লেনদেন হারাম হওয়ার পক্ষে ফকীহরা প্রসিদ্ধ হাদীসটি দিয়ে দলীল প্রদান করেছেন যেটি ইমাম আহমদ (৬২৩৯), আবু দাউদ (৩৩৫৪), নাসাঈ (৪৫৮২), তিরমিযী (১২৪২) ও ইবনে মাজাহ (২২৬২) বর্ণনা করেছেন: ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি (বিলম্বে) দীনারের বিনিময়ে উট বিক্রি করতাম, আর মূল্য গ্রহণের সময় দিরহাম নিতাম। আবার দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দীনার নিতাম। এ ব্যাপারে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন: “এরূপ গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই, তবে সেদিনের বাজারদরে গ্রহণ করবে এবং এমন অবস্থায় তোমরা পরস্পর পৃথক হবে যে তোমাদের মাঝে কিছু বাকি নেই।”[হাদীসটি বেশ কিছু আলেম সহিহ বলে গণ্য করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন: ইমাম নববী, আহমদ শাকির। কেউ কেউ ইবনে উমরের বক্তব্য হিসেবে এটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা হিসেবে নয়। তাদের মাঝে রয়েছেন হাফেয ইবনে হাজার ও আলবানী। দেখুন: ইরওয়াউল গালীল (৫/১৭৩)]
হারাম হওয়ার ভিন্ন আরো একটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো: আপনি যদি পরিশোধের দিনের চেয়ে বেশি গ্রহণ করে থাকেন তাহলে এমন কিছু থেকে লাভ করলেন যার লোকসানের ঝুঁকি আপনি নেননি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কিছু থেকে লাভ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন যার লোকসানের ঝুঁকি গৃহীত হয়নি।[হাদীসটি সুনান প্রণেতারা সহিহ সনদে বর্ণনা করেন]
তৃতীয় রূপ:
ঋণ পরিশোধের সময়ে উভয়ে ভিন্ন মুদ্রায় পরিশোধে সম্মত হওয়া। কিন্তু তারা উভয়ে এমন অবস্থায় পৃথক হয়ে যাওয়া যে তাদের মধ্যে কিছু বাকি রয়ে গেছে। যেমন: ঋণ যদি হয় এক হাজার ডলার এবং পরিশোধের সময় তারা সম্মত হয় যে পাউন্ডে পরিশোধ করবে। উদাহরণস্বরূপ: ৫০০০ পাউন্ড। এরপর ঋণদাতা তার কাছ থেকে ৪০০০ পাউন্ড গ্রহণ করে এবং ১০০০ পাউন্ড ঋণগ্রহীতার দায়ে থেকে যায়। এমনটি হওয়া জায়েয নেই। কারণ এক মুদ্রার সাথে অন্য মুদ্রার বিনিময়ের শর্ত হলো সেটা হাতে-হাতে নগদ হতে হবে; যেমনটা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
খাত্তাবী রাহিমাহুল্লাহ উপর্যুক্ত ইবনে উমরের হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন: “শর্ত হলো তারা এমতাবস্থায় আলাদা হয়ে যাবে না যে, তাদের মাঝে কিছু বাকি রয়ে গেছে। কারণ দীনারের বিনিময়ে দিরহামের লেনদেন হলো এক্সচেঞ্জ (মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা বিক্রি)। এমন লেনদেন হাতে-হাতে হওয়া ছাড়া সঠিক নয়।”[আউনুল মা’বূদ গ্রন্থ থেকে চয়নকৃত]
কিন্তু যদি কয়েক দফায় ঋণ পরিশোধ করা হয় তাহলে প্রত্যেক দফা পরিশোধের সময় ঐ দিনের মূল্য গ্রহণে উভয়ে সম্মত হতে সমস্যা নেই। কারণ এটি মুদ্রা বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়া থেকে মুক্ত।
এ মাসয়ালায় আলেমরা যা বলেছেন তার কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: ‘আমি একজন মানুষ থেকে ফরাসি মুদ্রায় কিছু ঋণ নিয়েছিলাম এই শর্তে যে আমি ফ্রান্সে গেলে তাকে পরিশোধ করে দিব। কিন্তু আলজেরিয়ায় আসার পর সে আমাকে অতিরিক্তসহ আলজেরিয়ান দিরহামে পরিশোধ করতে বলে। এর হুকুম কী?
তারা উত্তর দেয়: আপনি আলজেরিয়ায় অনুরূপ ফরাসি মুদ্রায় অথবা পরিশোধের দিনে ঐ মুদ্রার বিনিময় মূল্যে আলজেরিয়ান মুদ্রা প্রদান করতে পারবেন। এমনটি আপনার জন্য জায়েয। তবে আপনারা পৃথক হওয়ার আগেই হস্তান্তর হতে হবে।’[ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ (১৪/১৪৩)]
তাদেরকে (১৪/১৪৪) আরো জিজ্ঞাসা করা হয়: এক মুদ্রায় ঋণ গ্রহণ করে কয়েক মাস পরে অন্য মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করার হুকুম কী? ঋণের এ সময়কালের মধ্যে মুদ্রার মূল্যে তারতম্য হতে পারে।
তারা উত্তর দেয়: ‘যদি কোনো ব্যক্তি মুনাফা দেয়ার শর্ত দেয়া ছাড়া মুদ্রা ঋণ নেয় অথবা ঋণ পরিশোধের সময় পরিশোধের দিনের মূল্যে অন্য মুদ্রা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করে যার মধ্যে ঋণদাতার জন্য উপকারবহন কোন শর্ত না থাকে তাহলে এটি জায়েয। কারণ এতে মুসলিমদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও প্রয়োজন পূরণ অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে যদি ঋণের সাথে মুনাফা দেয়ার শর্ত করে অথবা এই মুদ্রার বিনিময়ে ভিন্ন মুদ্রা প্রদানের শর্ত করে কিংবা ঋণদাতার কোন উপকার করার শর্ত করে তাহলে সেটি হারাম হবে। কারণ এটি কুরআন-সুন্নাহ ও আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে হারাম সুদের অন্তর্ভুক্ত।’[সমাপ্ত]
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আমার এক আত্মীয় কায়রোতে থাকেন। তিনি আমার কাছে ২৫০০ মিশরী পাউন্ড ঋণ চেয়েছিলেন। আমি তাকে ২০০০ ডলার পাঠিয়েছিলাম। ঐ ডলার বিক্রি করে তিনি ২৪৯০ মিশরী পাউন্ড পেয়েছিলেন। এখন তিনি ঋণ পরিশোধ করতে চান। উল্লেখ্য, পরিশোধের সময় ও ধরন নিয়ে আমরা কোন আলাপ করিনি। প্রশ্ন হলো: আমি কি তার কাছ থেকে ২৪৯০ মিশরী পাউন্ড নিব যার বর্তমান মূল্য ১৮০০ আমেরিকান ডলার (আমি তাকে ডলারে যা দিয়েছি তার চেয়ে পরিমাণে কম); নাকি আমি ২০০০ ডলারই তার কাছ থেকে নিব? উল্লেখ্য, ২০০০ ডলার নিলে তাকে প্রায় ২৮০০ মিশরী পাউন্ড দিয়ে এ ডলার কিনতে হবে (অর্থাৎ সে যে মূল্য পেয়েছিল তার চেয়ে ৩০০ মিশরী পাউন্ড বেশি দিয়ে কিনতে হবে)?
তিনি উত্তর দেন: “তার দায়িত্ব হলো আপনি তাকে যে ডলার ঋণ প্রদান করেছেন তিনি আপনাকে সেটিই ফিরিয়ে দিবেন। কেননা আপনার কাছ থেকে তিনি ডলারই ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু যদি আপনারা দুজনে সম্মত হন যে তিনি আপনাকে মিশরী পাউন্ডে পরিশোধ করবেন, তাহলে সমস্যা নেই। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমরা বাকী’ বা নাকী’তে (স্থানের নাম) দিরহামের বিনিময়ে উট বিক্রি করতাম। এর বদলে আমরা দীনার নিতাম। আবার দীনারে বিক্রি করে এর বদলে আমরা দিরহাম নিতাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “পরিশোধের দিনের বাজারদরে নিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে শর্ত হলো তোমরা এমন অবস্থায় পৃথক হবে না যে তোমাদের মধ্যে কিছু বাকি রয়ে গেছে।” এটি এক মুদ্রাকে ভিন্ন মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করা, যা স্বর্ণকে রৌপ্যের বিনিময়ে বিক্রি করার সদৃশ। যদি আপনি ও তিনি এই মর্মে একমত হন যে এই ডলারের বদলে তিনি আপনাকে মিশরী পাউন্ড দিবেন এবং শর্ত হবে মুদ্রা পরিবর্তনের চুক্তি করার সময়ের মূল্য অনুযায়ী প্রাপ্য পাউন্ডের চেয়ে বেশি পাউন্ড আপনি নিবেন না; তাহলে এতে কোনো আপত্তি নেই। উদাহরণস্বরূপ যদি ২০০০ ডলারের মূল্য এখন হয় ২৮০০ পাউন্ড তাহলে আপনি তার কাছ থেকে ৩০০০ পাউন্ড নিতে পারবেন না। তবে আপনি ২৮০০ পাউন্ড নিতে পারবেন। আবার তার কাছ থেকে শুধু ২০০০ ডলারও নিতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি সেদিনের মূল্যে অথবা তার চেয়ে কম মূল্যে সেটি নিতে পারবেন। এর চেয়ে বেশি নিতে পারবেন না। কারণ আপনি যদি বেশি নেন তাহলে এমন কিছু থেকে লাভ করলেন যার লোকসানের ঝুঁকি আপনি নেননি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন লাভ নিষিদ্ধ করেছেন যার লোকসানের ঝুঁকি গৃহীত হয়নি। আর যদি আপনি এর চেয়ে কমে গ্রহণ করেন, তাহলে আপনি আপনার কিছু অধিকার গ্রহণ করলেন এবং বাকিটুকুতে তাকে ছাড় দিলেন। এতে কোনো সমস্যা নেই।”[ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ (২/১৪৪) থেকে সমাপ্ত]
দেখুন (23388) ও (12541) নং প্রশ্ন।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।